মার্কিন চাপ ও মোদীর ওষুধ নীতি

নরেন্দ্র মোদী নিজের পিঠ চাপড়ালে অবাক হওয়ার কারণ নেই। হাজার হোক, বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠন (ডব্লিউটিও) খাদ্যশস্য মজুত করার পরিমাণের যে নতুন ঊর্ধ্বসীমা স্থির করতে চাইছে, তাতে ভারতের আপত্তি মেনে নিয়েছেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু, এই ‘কূটনৈতিক জয়’-এর উল্টো দিকে যে ছবিটা আছে, সেটা নিঃশর্ত নতিস্বীকারের। ভারত সরকার পরম আগ্রহে মার্কিন সরকার ও সে দেশের বৃহদায়তন ওষুধ সংস্থাগুলির (‘বিগ ফার্মা’ নামে যারা বেশি পরিচিত) আবদার মেনে নিয়েছে। ফল দেশবাসীর পক্ষে মারাত্মক হতে পারে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম থেকে ওষুধের ফর্মুলার মেধাস্বত্ব, এমন বহু প্রশ্নেই গত ছ’মাসে নরেন্দ্র মোদীর সরকার এমন অবস্থান নিয়েছে যা মার্কিন বহুজাতিকগুলির স্বার্থের অনুকূল। এই সরকারি সিদ্ধান্তগুলির প্রথমটি গৃহীত হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে, মোদীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের ঠিক আগে। গত মে মাসে ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি (এনপিপিএ) যে নির্দেশিকা প্রকাশ করেছিল, সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার স্থির করে, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। এই নির্দেশিকাটি তৈরি হয়েছিল ২০১২ সালের ড্রাগ কন্ট্রোল অ্যাক্ট-এর অধীনে। এই আইন অনুসারে, যে ওষুধগুলি ‘জীবনদায়ী ওষুধ’-এর শ্রেণিভুক্ত নয়, তার দাম স্থির করে দেওয়ার ক্ষমতাও এনপিপিএ-র হাতে থাকবে। এই আইন মেনেই এনপিপিএ জুলাই মাসে ১০৮টি ওষুধের দাম বেঁধে দেয়। সেগুলোর বেশির ভাগই কার্ডিয়াক সমস্যা ও ডায়াবেটিসের ওষুধ। দুটি রোগই ভারতে বিপজ্জনক রকম বেশি। তার দু’মাসের মধ্যেই, সেপ্টেম্বরে, কেন্দ্রীয় সরকার এই নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশ দেয়। সরকারের সেই নির্দেশের পরবর্তী ব্যাখ্যায় জানা যায়, এই নির্দেশিকাটি অপরিবর্তিত থাকলেও এনপিপিএ ভবিষ্যতে আর এ রকম কোনও সিদ্ধান্ত করতে পারবে না। দেশের ক্রেতার সুবিধা ও প্রয়োজনের কথা ভেবেও না। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তটি এমন সময় ঘোষিত হল যে, কারও সংশয় হতেই পারে, হয়তো মার্কিন সফরের আগে সে দেশের ওষুধ নির্মাণকারী বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে ‘ঠিক সংকেত’ দেওয়ার জন্যই সরকার এই সিদ্ধান্ত করল।

রকার যে দেশের গরিব মানুষের স্বার্থের চেয়ে মার্কিন বহুজাতিকের স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তার দ্বিতীয় ইঙ্গিতটি আসতে খুব বেশি দেরি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর মার্কিন সফরের শেষ লগ্নে দু’দেশের যৌথ বিবৃতিতে একটি অনুচ্ছেদ ছিল, যাতে একটি বার্ষিক ‘হাই লেভেল ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ওয়ার্কিং গ্রুপ’ তৈরি করার কথা বলা হয়। এই গোষ্ঠী ‘দুই দেশের বাণিজ্য নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মেধাস্বত্বের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা নেবে’। ভারতে মেধাস্বত্বের ক্ষেত্রে যে বিচারকরা কাজ করছেন, মার্কিন ফার্মা সংস্থার লবিইস্টরা (যাঁরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক বা অন্য ধরনের সংস্থার স্বার্থরক্ষার কাজে নিয়োজিত) যাতে তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন, সেই পরিসর রাখারই ইঙ্গিত রয়েছে বিবৃতিটিতে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতি নিয়ে কাজ করেন, এমন বেশ কয়েক জন বিশেষজ্ঞ বলছেন, ছকটা চেনা। এমন ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করে তার মাধ্যমে বিগ ফার্মার স্বার্থের অনুকূল কঠোরতর মেধাস্বত্ব নীতি চাপিয়ে দেওয়ার কাজটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিত করে থাকে। নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ল’র অধ্যাপক ব্রুক বেকার সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, এই ওয়ার্কিং গ্রুপ আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটা নিশ্চিত জায়গা করে দেবে, যেখান থেকে ভারতকে পেটেন্ট সুরক্ষার কঠোরতর নীতি প্রণয়নের জন্য নিয়মিত চাপ দেওয়া হবে। নলেজ ইকনমি ইন্টারন্যাশনাল-এর জেমি লাভ বলছেন, ওষুধের পেটেন্ট সংক্রান্ত নীতি সংস্কার এবং কম্পালসরি বা আবশ্যিক লাইসেন্সিং-এর নিয়ম প্রত্যাহার বা শিথিল করার জন্য ভারত চাপে থাকবেই।

আবশ্যিক লাইসেন্সিং ডব্লিউটিও অনুমোদিত একটি ‘নমনীয়’ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় কোনও দেশের সরকার সে দেশে কোনও সংস্থাকে একটি পেটেন্টেড ওষুধ উত্‌পাদনের অনুমতি দিতে পারে, মেধাস্বত্বের অধিকারীর সম্মতি ছাড়াই। এই ছাড়পত্রটি ওষুধ প্রস্তুতকারক বহুজাতিকগুলির বিরুদ্ধে উন্নয়নশীল দেশগুলির মস্ত হাতিয়ার বিশেষত বিবিধ জীবনদায়ী ওষুধের ক্ষেত্রে। এই পথেই তারা বিগ ফার্মার একচেটিয়া ব্যবসা ভাঙতে পারে। তবে, শুধু উন্নয়নশীল দেশই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই রাস্তা ব্যবহার করেছে। ২০০৯ সালে যখন অ্যানথ্রাক্স মহামারী ছড়িয়েছিল, তখন একটি সংস্থার ওষুধের দাম কমানোর জন্য এই পথেই হাঁটার হুমকি দিয়েছিল বারাক ওবামার সরকার।

সরকারের এই অবস্থানগুলি দেখার পরেও যদি তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনও সংশয় থাকে, সরকারই সেটাও দূর করার ব্যবস্থা করেছিল অক্টোবর মাসে। অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমকে দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করে। এ বছরই মার্চ মাসে তিনি মার্কিন সরকারকে ফার্মাসিউটিক্যাল পেটেন্ট লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি বিশেষ দেশের বিরুদ্ধে ডব্লিউটিও’তে নালিশ ঠোকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। হ্যঁা, সেই দেশটার নাম ভারত। ডক্টর সুব্রহ্মণ্যম তখন মার্কিন মুলুকে কর্মরত ছিলেন। তিনি ভারতের পেটেন্ট আইন সংস্কারের পক্ষেও জোর সওয়াল করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, যা হোক কিছু একটা তৈরি করে তারই পেটেন্ট নেওয়া অথবা পুরনো ওষুধেই সামান্য কিছু পরিবর্তন করে তাকে ফের নতুন ওষুধ বলে দাবি করে পেটেন্ট নেওয়ার মতো ব্যবস্থা যে আইনে আছে, তাকে ঠিক করতেই হবে।

বিভিন্ন দেশে মেধাস্বত্ব রক্ষার ব্যবস্থার পর্যালোচনা করছিল মার্কিন কংগ্রেসের একটি কমিটি। তারই অংশ হিসেবে অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম এক সন্দর্ভ জমা করেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘পেটেন্ট আইনের ৩(ঘ) ধারা বা কম্পালসারি লাইসেন্সিং-এর ফলে যে সমস্যাগুলি তৈরি হয়েছে, ভারত যদি তা সমাধান না করে... তবে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় মামলা ঠোকার কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেবে দেখা উচিত।’ তাঁর যুক্তি ছিল, ভারত ডব্লিউটিও-র নিয়মগুলিকে গুরুত্ব দেয়। অতীতে বিভিন্ন বিবাদে সংস্থা যে রায় দিয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারত তা মেনেছে। অতএব ডব্লিউটিও’র দ্বারস্থ হওয়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে, কারণ কোনও একতরফা বা দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্ত নিলে যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তিক্ততা তৈরি হয়, এ পথে সেটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে। সুব্রহ্মণ্যম লেখেন, ‘কার্যকারিতার ভিত্তিতেও পেটেন্ট দেওয়ার যে অতিরিক্ত ব্যবস্থাটি পেটেন্ট আইনের ৩(ঘ) ধারায় আছে, ভারত সেটি ছেঁটে ফেলার কথা ভাবতে পারে।’ আরও লেখেন, ‘ভারতের আবশ্যিক লাইসেন্সিং-এর ওপর স্থগিতাদেশ জারি করা উচিত।’ সুব্রহ্মণ্যমের দুটি কথাই মার্কিন ফার্মা লবির দাবির খুব কাছাকাছি।

কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তগুলি দীর্ঘমেয়াদে দেশের মানুষের, বিশেষত গরিব মানুষের, বিপুল ক্ষতি করবে। তেমনই আর এক ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত করেছেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে। ২০১১ সালে রাজস্থানের তত্‌কালীন কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত যে ‘মুখ্যমন্ত্রী নিঃশুল্ক দাওয়া যোজনা’ চালু করেছিলেন, এই অগস্টে বসুন্ধরা জানালেন, সেটিকে বহুলাংশে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। তিনি বললেন, সকলের জন্য নয়, এ বার থেকে প্রকল্পটি গরিবের জন্য ‘টার্গেটেড’ হবে। যাঁরা জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের আওতায় আসবেন, তাঁরাই এই যোজনার সুবিধা পাবেন। যোজনাটিকেও নতুন ভাবে সাজা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর একটি ঘোষণায় ৮৫ লক্ষ মানুষ এর থেকে বাদ পড়ে গেলেন।

ওষুধকে সবার সাধ্যায়ত্ত করার কঠিন কাজটি এই সিদ্ধান্তগুলির ফলে কঠিনতর হয়ে গেল। ভারত হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র ক্ষেত্রে চিনের চেয়ে এগিয়ে ছিল। ওষুধ নির্মাণ তার মধ্যে অন্যতম। মোদী সরকার যে সিদ্ধান্তগুলি করল, তাতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানটি অর্থহীন হয়ে পড়ে, অন্তত দেশের ওষুধ সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে, যারা এ দেশের এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জন্য অপেক্ষাকৃত সস্তায় ওষুধ তৈরি করত।

Featured Book: As Author
Media Ethics
Truth, Fairness and Objectivity
 
Documentary: Featured
Featured Book: As Publisher
Loose Pages
Court Cases That Could Have Shaken India
  • Authorship: Co-authored with Sourya Majumder
  • Publisher: Paranjoy
  • 376 pages
  • Published month:
  • Buy from Amazon