বড় বিস্ময় জাগে: আদানি গোষ্ঠীর সাফল্যের গতি, নিয়ন্ত্রণের পরিমাণ তুলনাবিহীন

ভারতের ইতিহাসে বড় শিল্পপতি এবং তাঁদের আকাশছোঁয়া সাফল্যের নিদর্শন কম নয়। বিভিন্ন সময়ে এঁদের অনেকেরই ব্যবসা-সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছে তীব্র গতিতে। হাতের কাছেই উদাহরণ— টাটা গোষ্ঠী, বিড়লা গোষ্ঠী (বিশেষত বিভাজনের আগে), অম্বানী গোষ্ঠী ইত্যাদি। কিন্তু সম্ভবত এঁদের সেই গতিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে গৌতম আদানির নেতৃত্বে আদানি ঘরানা। যে ভাবে আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসা ভারতের অর্থ-ব্যবস্থার আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে ডানা মেলেছে, তার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে তাদের একটা ‘দখল’ বা নিয়ন্ত্রণ তৈরি হয়েছে, তা সত্যি বলতে অনেককে আশ্চর্য করেছে।

অথচ, বছর কুড়ি আগেও গৌতম আদানির নাম খুব কম লোকই শুনেছিলেন। তিনি ছিলেন মুম্বইয়ের জ়াভেরি বাজারে হিরে আমদানি-রফতানির ব্যবসাকারী। আজ তাঁর সাম্রাজ্য ভারতের প্রত্যেক অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। কোথায়? সেই তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ।

গুজরাতের মুন্দ্রায় বন্দরের পাশে ভারতের সব থেকে বড় বিশেষ আর্থিক অঞ্চল (এসইজ়ে়ড বা সেজ়)। পরিচালনার দায়িত্ব? আদানিদের। বেসরকারি সমুদ্রবন্দরের মধ্যে সব থেকে বড় আদানি পরিচালিত মুন্দ্রা বন্দর। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে সব থেকে বড় বন্দর মুম্বইয়ের কাছে জওহরলাল নেহরু পোর্ট ট্রাস্ট। তার পরেই দ্বিতীয় স্থানে মুন্দ্রা।

ভারতের সমুদ্রতটে— পশ্চিম এবং পূর্ব মিলিয়ে— ১২টি বন্দরের পরিচালনার (অপারেশন) দায়িত্বে রয়েছে আদানিরা। ১৩ নম্বরটি হওয়ার কথা পশ্চিমবঙ্গের তাজপুরে। তার কাজ এখনও শুরু হয়নি, তবে বরাত আদানিদের পকেটে। ভারতের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় বন্দর-ব্যবসায় নোঙর ফেলেছে আদানি গোষ্ঠী। যেমন, অস্ট্রেলিয়া, ইজ়রায়েল, শ্রীলঙ্কা (কলম্বোর একটি টার্মিনাল) ইত্যাদি। এই মুহূর্তে ভারতের সাতটি বিমানবন্দরের পরিচালনার দায়িত্বেও তারা।

তা ছাড়াও রয়েছে অনেক ধরনের ব্যবসা। আদানিদের হাতে রয়েছে জাহাজ, রেলের রেক, গুদাম ইত্যাদি। এবং এই সমস্ত কিছুই কিন্তু পড়ে পরিকাঠামো-ব্যবসার আওতায়। পরিকাঠামো-ব্যবসার সাম্রাজ্য এখানেই শেষ নয়। বিভিন্ন রাস্তা তৈরিতেও তাদের সগর্ব উপস্থিতি। এমনকি বায়ু, নৌ ও স্থলসেনার জন্য ইজ়রায়েলি সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ড্রোন তৈরি করেও সেই আদানি গোষ্ঠী। তাদের তালিকায় আছে ডেটা সেন্টারও (তথ্য-কেন্দ্র)।

খননের ক্ষেত্রটিতেও বিস্তৃত সাম্রাজ্য আদানিদের। যেমন, কয়লা খনন ও খনি পরিচালনায় দেশে কোল ইন্ডিয়ার পরেই দ্বিতীয় স্থানে তারা। কেবল এ দেশে নয়। কয়লার খনি তারা পরিচালনা করছে অন্যান্য দেশেও, যেমন অস্ট্রেলিয়ায়, ইন্দোনেশিয়ায়।

আদানিদের ঘরে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রও ১০টির বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনটিপিসি-র পরে তারা ভারতে দ্বিতীয়। বিভিন্ন শহরে পাইপবাহিত রান্নার গ্যাস ও গাড়ির জ্বালানির গ্যাস বিতরণকারী হিসেবেও দেশে দ্বিতীয় আদানি গোষ্ঠী। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্দ্রপ্রস্থ গ্যাসের পরেই। সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুতেও তাদের উপস্থিতি রয়েছে।

রান্নার তেল বিক্রিতে আদানিদের ব্র্যান্ড ‘ফরচুন’ দেশে এক নম্বর। সারা দেশের বাজারের প্রায় ২০ শতাংশ তাদের দখলে। চাল এবং গম রাখার গুদামের ক্ষেত্রেও এফসিআই-এর পরে তারাই দু’নম্বর। সিমেন্টেও তা-ই। আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীর ঠিক পরেই।

আপেল বিক্রিতে দেশে এক নম্বর কারা? সেই আদানি! এই একই গোষ্ঠী ডানা মেলেছে চিনি, ডাল ইত্যাদির ব্যবসাতেও।

আবাসন তৈরির প্রায় ৩০০টি প্রকল্প এই মুহূর্তে আদানি গোষ্ঠীর ঝুলিতে। যার মধ্যে রয়েছে মুম্বইয়ের ধারাভিতে বড় মাপের কিন্তু বিতর্কিত প্রকল্পও।

এবং অবশ্যই গণমাধ্যম। ইন্ডিয়া টিভি-র পরে এখন এনডিটিভি-র মালিকানাও তাদের হাতে।

ব্যবসা সম্প্রসারণে কার্যত টাটা, বিড়লা, অম্বানীদের টপকে অমন বিদ্যুৎগতি যেমন অনেককে অবাক করেছিল, তেমনই সকলকে বিস্মিত করেছে আদানিদের বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারদরের উল্কার গতিতে পতন। তাঁরা বলছেন, ভারতের ইতিহাসে আর কোনও বড় শিল্পগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারদর নাকি কখনও এই গতিতে পড়েনি।

এ দিকে ২৪ জানুয়ারি হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে শেয়ার বাজারে ‘রক্তপাত’ শুরু হল। আদানিদের বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক দ্রুততায় পড়তে শুরু করল। কিছু সংস্থার ক্ষেত্রে তা অর্ধেকে নেমে এল, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে দাম কমে গেল ৮০ শতাংশ পর্যন্ত।

আমার বয়স ৬৭ বছর। প্রায় ৪৫ বছর সাংবাদিকতা করছি। চিরকাল শিখে এবং ক্লাসরুমে শিখিয়ে এসেছি যে, সাংবাদিককে কখনও সংবাদ বা খবর হতে নেই। তা কখনও হওয়া উচিত নয়। তবু অতি বিনীত ভাবেই আদানি-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে এখানে নিজের সম্পর্কে দু’চারটি কথা লিখছি। নিজের ঢাক পেটাতে নয়, এই বিষয় সম্পর্কিত কতকগুলি কথা বলার আছে বলে।

হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট মোট ৩২ হাজার শব্দের। সেখানে সাংবাদিক হিসেবে একমাত্র আমার নাম রয়েছে। হিন্ডেনবার্গ যে ৮৮টি প্রশ্ন আদানিদের করেছিল, তার মধ্যে ৮৪ নম্বরটিতে আমার নাম। আদানিদের কাছে ওই প্রশ্ন ছিল, আপনারা যদি সত্যিই মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, তা হলে এক জন স্বাধীন সাংবাদিক পরঞ্জয়কে গ্রেফতারের চেষ্টা কেন? আদানি গোষ্ঠীর আইনজীবীর জবাব, ‘আমরা কিছু করিনি। যা করার, বিচারপতি করেছেন।’

কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ হয় না। আমাকে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-র সম্পাদকের পদ থেকে সরতে হয়েছিল ২০১৭ সালের জুলাইয়ে। তার পিছনে ছিল আদানিদের সম্পর্কে একটি লেখা। তা নিয়ে আজও দু’টি মামলা চলছে গুজরাতের মুন্দ্রায়। আরও চারটি মামলা চলছে দেশের বিভিন্ন আদালতে। আমি ভারতের নাগরিক। অতি সাধারণ মানুষ। অথচ আমার বিরুদ্ধে ছ’টি মানহানির মামলা চালাচ্ছে আদানির মতো বিশাল গোষ্ঠী।

আবারও বলছি, নিজের সম্পর্কে বলা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু আজ আড়াই বছর পরে এ নিয়ে আমি মুখ খুলতে বাধ্য হচ্ছি। আমি নিজে যা বিশ্বাস করি, যা পড়াই, সাংবাদিকদের সেই অলক্ষ্যে থাকার পাঠকে কার্যত কিছুটা লঙ্ঘন করেই আমার বক্তব্য এই সার্বজনিক মঞ্চে তুলে ধরছি।

Featured Book: As Author
Sue the Messenger
How legal harassment by corporates is shackling reportage and undermining democracy in India
 
Featured Book: As Publisher
Holy Cows and Loose Cannons: The Duffer Zone Chronicles
  • Authorship: Avay Shukla
  • Publisher: AuthorsUpFront, Paranjoy
  • 244 pages
  • Published month:
  • Buy from Amazon